ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সামরিক অভিযানের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনায় হোয়াইট হাউস এবং গোয়েন্দা মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে এই ঘটনায় ট্রাম্প প্রশাসনের তিন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা কঠোর জবাবদিহির মুখে পড়েছেন। ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে একাধিক গোপন ড্রোন হামলা ও সাইবার অপারেশন চালিয়েছে, যা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি।
কীভাবে ফাঁস হলো এই গোপন তথ্য?
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এই সংবেদনশীল তথ্য পেন্টাগনের একটি অভ্যন্তরীণ ডাটাবেস থেকে ফাঁস হয়েছে, যা শুধুমাত্র উচ্চপদস্থ সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। তদন্তে দেখা গেছে, গোপন নথিগুলো প্রথমে একটি বেসরকারি অনলাইন ফোরামে প্রকাশিত হয়, যা পরে দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
সূত্র জানিয়েছে, এই ফাঁস হওয়া নথিগুলোতে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের ঘাঁটি, গোপন অস্ত্র সরবরাহের পথ এবং হামলার পরিকল্পনা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের তথ্য ফাঁস মার্কিন নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করেছে এবং ইয়েমেনের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
কংগ্রেসে কঠোর প্রশ্নবাণে তিন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা
কংগ্রেসের গোয়েন্দা ও সামরিক বিষয়ক যৌথ কমিটির সাম্প্রতিক শুনানিতে সিআইএ পরিচালক জিনা হাসপেল, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) প্রধান পল নাকাসোনে এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিআইএ) প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্কট বেরিয়ার-কে এ বিষয়ে কঠোর জবাবদিহির মুখোমুখি করা হয়েছে।
শুনানিতে সিনেটর মার্ক ওয়ার্নার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন:
“এই ধরনের স্পর্শকাতর তথ্য কীভাবে ফাঁস হলো, তা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। এই ধরনের ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য।”
অন্যদিকে, রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন:
“আমাদের গোয়েন্দা কাঠামোর মধ্যে কোথায় ফাঁকফোকর রয়েছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে।”
তিন কর্মকর্তার জবাবদিহি ও ব্যাখ্যা
সিআইএ পরিচালক জিনা হাসপেল শুনানিতে স্বীকার করেন যে, ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’ ছিল এবং এতে হুতিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান অপারেশনগুলো ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
“আমরা ইতোমধ্যে একটি উচ্চ-পর্যায়ের তদন্ত শুরু করেছি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি,” — বলেন হাসপেল।
এনএসএ প্রধান পল নাকাসোনে জানান, ফাঁস হওয়া তথ্যগুলোর বেশিরভাগই ছিল সাইবার গোয়েন্দা অপারেশনের অংশ, যা হুতিদের কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ও অস্ত্র সংগ্রহের পথ পর্যবেক্ষণ করছিল।
“এই তথ্য ফাঁস আমাদের গোপন অপারেশনগুলোর কার্যকারিতা ব্যাহত করেছে এবং হুতিদের হাতে কৌশলগত সুবিধা তুলে দিয়েছে,” — মন্তব্য করেন নাকাসোনে।
ডিআইএ প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্কট বেরিয়ার বলেন,
“এখন স্পষ্ট যে, আমাদের গোয়েন্দা কাঠামোতে নিরাপত্তা দুর্বলতা রয়েছে। আমরা সেই দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে কঠোর পর্যালোচনা করছি।”
হুতিদের সুবিধা এবং নতুন চ্যালেঞ্জ
গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তথ্য ফাঁসের ফলে হুতি বিদ্রোহীরা যুক্তরাষ্ট্রের অপারেশন সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পেয়ে গেছে, যা তাদের সামরিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ডেভিড গার্ডনারের মতে:
“এই ফাঁস হওয়া তথ্যের মাধ্যমে হুতিরা তাদের কৌশল পুনর্বিন্যাস করতে পারে এবং মার্কিন হামলাগুলো এড়িয়ে যেতে সক্ষম হবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধাক্কা।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
এই তথ্য ফাঁস নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল থেকেও প্রতিক্রিয়া আসছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, যারা ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে লড়াই করছে, তারা এই তথ্য ফাঁসে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন,
“মার্কিন গোয়েন্দা ত্রুটি আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই ধরনের ঘটনা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দেবে।”
কংগ্রেসের তদন্ত ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
কংগ্রেসের শুনানি শেষে একটি বাইপার্টিসান বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা ফাঁসের উৎস খুঁজে বের করবে এবং গোয়েন্দা তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নতুন পদক্ষেপ সুপারিশ করবে।
সিনেটর চাক শুমার বলেছেন:
“এই তদন্ত শুধু দোষী চিহ্নিত করতেই নয়, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে আমাদের নীতিমালা ও কাঠামো পুনর্মূল্যায়নের জন্য।”
এই তথ্য ফাঁস মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ইয়েমেনে চলমান সামরিক অভিযানের তথ্য প্রকাশিত হওয়ায়, যুক্তরাষ্ট্রের গোপন কৌশল প্রকাশিত হয়েছে এবং হুতি বিদ্রোহীদের সুবিধা করে দিয়েছে।